ফকির উয়ায়ছী:
ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। যাকাত এবং সালাত (নামায) ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। একটা বাদ দিয়ে আর একটি সম্ভব নয়। আর এটা মানা সব মুসলমনের জন্যই ফরজ। আল্লার হুকুমকৃত ফরজকে বাদ দেওয়ার কোন উপায় নাই। যাকাত আরবী শব্দ এর বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘পবিত্রতা’ বা ‘শুদ্ধিতা’। ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে জানানোর মত জ্ঞান আমার নাই।
আমি কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ইতিহাস চর্চা করে জানতে পারি আপনাদের সামনে তুলে ধরি রেফারেন্স সহ বিজ্ঞ পাঠকগন চিন্তা করে সঠিক যেটা গ্রহন করবেন। আমাকে অনেকেই বলেছেন যাকাত সম্পর্কে আমার মতামত লিখতে। গত কয়েকদিন আগে এক ভদ্র মহিলা আমার ‘মা’ যখন যাকাত নিয়ে আমার কাছে জানতে চাইলেন তার সাথে আলোচনার পর মনে হলো সামনে আসছে যাকাত দেওয়ার সময়। তাই এই বিষয়টা নিয়ে লেখার ইচ্ছা থেকেই চেষ্টা করা বাকী আপনাদের বিবেকের উপর। চিন্তা করে দেখবেন।
আমাদের মুসলিম সমাজে যারা বংশ পরমপরায় টাকা ওয়ালা তারা তাদের পূর্ব পুরুষদেরকে দেখেই প্রচলিত যাকাত দিয়ে থাকেন। আর যারা নব্য ধনবান তারাও পুর্বে দেখা ধনবানদের মত যাকাত দেওয়া শুরু করেন দিতে হবে মানুষ যেন বলে অমুক বাড়ির সাহেব যাকাত দিচ্ছেন। এই যাকাতের সামগ্রী আনতে গিয়ে দুর্বল দেহের অধীকারী ২/৪ মানুষের পায়ে পিষ্ট হয়ে যত বেশী মানুষ মারা যাবে। যাকাত প্রদানকারীর নাম তত বেশী ছড়িয়ে পরবে। মানুষের সামনে চমকদার গল্প এই আমার যাকাতের সময় যাকাত নিতে এতভীড় হয়েছিল বেশ কয় জন মারা গেছে। মানুষের কাছে গল্প বললেও চিন্তা করা উচিৎ আল্লা জিজ্ঞাসা করতে পারেন তোমার দান করতে আমার বান্দার প্রান কেন গেল?
প্রথমেই বলতে হয় যাকাত শব্দের অর্থ যেহেতু ‘পবিত্রতা’ বা ‘শুদ্ধিতা’ এই শব্দেরটি সাথে ধনি এবং গরীরের পার্থক্য থাকার কোন কারণ নাই। কারণ পবিত্রতার সাথে টাকা পয়সার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। কোরআনের একটি আয়াতের দিকে নজর দিলেই বুঝা যাবে। ৫৮ নং সূরা মুজাদালাহ ১৩ নং আয়াতে বলছেন “(অত:পর যখন তোমরা সদকা দিতে পারলে না এবং আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করে দিলেন, তখন তোমরা যথারীতি নামাজ কায়েম কর, যাকাত সম্পাদন কর)”। আল্লা যা বলেছেন একবার কি ভেবে দেখবেন? যে মানুষ সামান্য সাদাকা দিতে পারছেনা তাকেই আবার যাকাত দিতে বলেছেন! ধরুন আমি বললাম ভাই আমাকে ৫০টা টাকা (সদকা) দিন। আপনি বললেন আমার কাছে নাই। তখন যদি আমি বলি আপনার কাছে টাকা নাই ঐ মানুষটিকে ৫০০ টাকা যাকাত দিবেন। আমার এই কথায় নিশ্চয়ই আমাকে পাগল মনে হচ্ছে। আমার মত অধমকে যা খুশি তাই ভাবা যায়। তবে অনুরোধ রইল ৫৮:১৩ আয়াতটি ভাল ভাবে পড়ে চিন্তা করবেন। আমাকে যাই ভাবেন ঐ আয়াত পড়ে উল্টাপাল্টা ভাবার দুসাহস করবেন না। আল্লা যে উদ্দেশ্য করে ঐ আয়াতটি বলেছেন সেটা জানতে চেষ্টা করুন। আল্লা ঠিকই বলেছেন আমরা বুঝতেই ভুল করছি আসল কথাটা। আল্লা এই আয়াতে যে যাকাতের কথা বলেছেন টাকা পয়সার সাথে সেটার কোন সম্পর্ক নাই। অন্য যাকাত এর কথা বলেছেন। আল্লা সে যাকাতের কথা বলেছেন যা আল্লা প্রতিটি সৃষ্টিকেই দিয়েছেন।
কিন্তু মালের যাকাত অবশ্যই দিতে হবে হাদিস মোতাবেক। আল্লা যে যাকাতের কথা ৫৮ নং সূরা মুজাদালাহ ১৩ নং আয়াতে বলেছেন ইসলামের সত্য ধারকগনরাই এর সঠিক উত্তর দিতে পারবেন। কিন্তু যেতে হবে সেই সব জ্ঞানী লোকের কাছে। আল্লা যাকাত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ৩২ আয়াত আমি পেয়েছি তা আমি উল্লেখ করছি।
যাকাত সম্পর্কিত আয়াত ২:-৪৩-৮৩-১১০-১৭৭-২৭৭। ৪:৭৭-১৬২। ৫:১২-৫৫। ৭:১৫৬। ৯:৫-১১-১৮-৬০-৭১-১০৩-১০৪। ১৯:৩১-৫৫। ২১:৭৩। ২২:৪১-৭৮। ২৩:৪। ২৪:৩৭-৫৬। ২৭:৩। ৩১:৪। ৩৩:৩৩। ৪১:৭। ৫৮:১৩। ৭৩:২০। ৯৮:৫। এই ৩২ আয়াত নিয়ে আলোচনা করতে চেষ্টা করবো। তবে আর আগে যাকাত দেওয়া যে কতটুকু জরুরী সে ব্যপারে কিছু আলোচনা করতে চাই।
যাদের ওপর অর্থের যাকাত দেওয়া অবধারিত: যাদের ওপর যাকাত ওয়াজিব তারা তিন প্রকার:
১. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক।
২. যাদের সম্পদের ওপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। তবে ফসলের ক্ষেত্রে এক বছর অতিবাহিত হওয়া জরুরি নয় বরং ফসলের যাকাতের সম্পর্ক ফসল পাকার সাথে।
৩.ফলের যাকাত ওয়াজিব হয় যখন তা পরিপক্কতা লাভ করে এবং খাওয়ার উপযোগী হয়। যাকাত সেসব লোক সকলের ওপর ওয়াজিব হয় যাদের নিকট সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ (৮৫ গ্রাম) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৫৯৫ গ্রাম) রৌপ্য অথবা এর সমান অর্থ প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক বছর যাবৎ সঞ্চিত বা জমা আছে। স্বর্ণ রুপার ওপর যাকাত বাঞ্ছণীয়: বর্তমান বাজার অনুসারে স্বর্ণ ও রৌপ্যের মূল্যের ব্যবধান অনেক বেশি। তবে দরিদ্র, অসহায় ও মিসকিনদের সুবিধা বিবেচনায় রুপার মূল্যই জাকাত ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা উচিৎ। তাই বলা যায় সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য (বর্তমান বাজার অনুসারে প্রায় ৬২-৬৩ হাজার টাকা) প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যমান থাকার অর্থই হল তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। তবে এ অবস্থায় যাকাত ওয়াজিব হওয়ার দু’টি শর্ত আছে, ১ম ঋণদার থাকা যাবে না। ২য় অতিরিক্ত সম্পদের মেয়াদ এক বছর পার হতে হবে। যেসব সম্পত্তিতে যাকাত বাঞ্ছণীয় : ১ম. জমিনে উৎপাদিত ফসল, ফল ও বীজের ওপর যাকাত ওয়াজিব। আল্লা বলেন, “তোমরা ফল খাও, যখন ফলন্ত হয় এবং হক দান কর কর্তনের সময়ে এবং অপব্যয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না।” -৬: ১৪১। রাসূল সা. বলেছেন, আল্লা প্রদত্ত পানি দ্বারা উৎপাদিত ফসলে দশ ভাগের এক ভাগ আর সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত জমিনের ফসলে বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। ২য়. গবাদি পশু যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়া, উট, ইত্যাদির ওপর যাকাতও ওয়াজিব। আল্লা পবিত্র কালামে বলেছেন, “গৃহপালিত পশু; যা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এর মধ্যে রয়েছে শীত বস্ত্রের উপকরণ এবং মানুষের জন্য উপকার।” (সূরা নাহাল : ৫-৬) এসব জীব-জন্তুর যাকাত ওয়াজিব হবে যখন মুক্ত বিচরণকারী এবং নিসাব পরিমাণ হয়। এসবের মধ্যে উটের হিসাব হল কমপক্ষে পাঁচটা আর গরু ত্রিশটি এবং ছাগল/ভেড়া চল্লিশটি। কিন্তু মুক্ত বিচরণকারী না হলে যাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে যদি ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হবে। ৩য়. স্বর্ণ, রৌপ্যেও যাকাত ওয়াজিব। স্বর্ণ ও রৌপ্য যে কোন ধরনের হোক না কেন এর যাকাত ওয়াজিব। তবে স্বর্ণের পরিমাণ কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা এবং রৌপ্যের পরিমাণ সাড়ে বায়ান্ন তোলা হতে হবে। ৪র্থ: ব্যবসার মালামালের মধ্যে যাকাত ওয়াজিব। জমি, গবাদি পশু, খাদ্য-পানীয় ইত্যাদি সবকিছুতেই যাকাত ওয়াজিব যদি ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে। সুতরাং মালিককে বছর শেষে হিসাব করে এসবের যাকাত পরিশোধ করতে হবে। কোন শ্রেনীর মানুষ যাকাত পাওয়ার অধিকার রাখে: ৯:৬০# যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লার নির্ধারিত বিধান। আল্লা সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। আল্লা তা’আলা কুরআন পাকে যাকাতের অর্থ ব্যায়ের খাতসমূহ উল্লেখ করে দিয়েছেন। কুরআনে যাকাতের অর্থ ব্যয়ের জন্য ৮টি খাত উল্লিখিত হয়েছে। ১। ফকির: ফকির যারা নিজেদের সাধারণ জীবন যাপন করতে পারে না। অনেক দুঃখে-কষ্টে কালাতিপাত করে- তাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে। হাদীস শরিফে বলা হয়েছে ‘তোমাদের মধ্যে যারা ধনী তাদের থেকে যাকাত নেয়া হবে, আর গরিবের মাঝে বিতরণ করা হবে।’ ২। মিসকিন: সহায়-সম্বলহীন হৃতসর্বস্ব ব্যক্তি যার নিকট নগদ অর্থ বলতে কিছুই নেই- অন্যের দ্বারে হাত পাতে এমন লোকদের যাকাত দেয়া যাবে। ৩। কর্মকর্তা-কর্মচারী: যাকাতের টাকা বা সম্পদ উসুল করার কাজে নিয়োজিত কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন ভাতার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। চাই এরা ধনী হোক অথবা গরিব। সর্বাবস্থায় এ যাকাতের থেকে তারা তাদের বেতন ভাতা গ্রহণ করতে পারবে। ৪। কৃতদাসকে মুক্তকরার জন্য: কৃতদাস বা কৃতদাসীকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। ৫। মুআল্লাফাতে কুলুব: অমুসলিম বা কাফের সম্প্রদায়ের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। যাতে তারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ৬। ঋণগ্রস্ত: ঋণগ্রস্ত কোন ব্যক্তির ওপর তার ঋণের বোঝা কমানো বা ঋণ মুক্ত করার উদ্দেশ্যে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। ৭। ফি সাবিলিল্লাহ খাত: ফি সাবিলিল্লাহ বলতে যারা আল্লাহর পথে বিভিন্ন ভাবে জিহাদরত তাদের সার্বিক সাহায্য করতে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যাবে। ৮। মুসাফিরদের জন্য: কোন মুসাফির ব্যক্তি পথিমধ্যে অর্থাভাবে বিপদগ্রস্থ বা অসহায় হয়ে পড়েছে। বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছার মত কোন সম্বল তার সঙ্গে নেই। এমতাবস্থায় যাকাতের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা বা লোকটির জন্য যাকাতের অর্থ গ্রহণ করা সম্পূর্ণ বৈধ।